মীরা

 কালচক্রের গতির নিরিখে ইতিহাস যে কখন কিংবদন্তি হয়ে যায়, তা নির্ণয় করা বড় দুষ্কর। দ্বাপর যুগের দ্বারকার একচ্ছত্র চক্রবর্তী সম্রাট এই গতিতেই তাঁর মানবীয় কর্ম সমূহকে ছাপিয়ে ঈশ্বর হয়ে উঠেছেন। তাঁকে কেন্দ্র করে রচিত সাহিত্যের সীমা নাই। ঠিক তেমন ভাবেই হয়ত মোঘল আমলের এক রাজপুত রাজকন্যা আজ স্থান পেয়েছেন মানুষের পূজা স্থলে। যদিও দেবতা বিজ্ঞানের অতি ক্ষীণ বোধের থেকেই মনুষ্যে দেবত্ব আরোপের প্রবণতা প্রবল হয়। মনুষ্যের মধ্যে দৈব গুণাবলী থাকা অবিশ্বাস্য নয়। কিন্তু সাক্ষাৎ দেবতা হয়ে ওঠা যেকোনো মানুষের পক্ষেই অসম্ভব। সূর্যযানের রশ্মিমণ্ডল মনুষ্য বাসযোগ্য নয়। বৈদিক বাঙময়ের কেন্দ্রে নিহিত তত্ত্ব সমূহের ঐকান্তিক বিশ্লেষণ করে আচার্য সায়ন তাঁর বেদের উপক্রমণিকাতে এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাহলে কি দেবতুল্য মনুষ্য পূজ্য নন? অবশ্যই পূজ্য; মান্য; অনুসরণীয় এবং কিছু ক্ষেত্রে অনুকরণীয়ও। বিচারের অসম্পূর্ণতা তখন তৈরি হয়, যখন উক্ত কর্তব্যগুলি আমরা কেবল দেবতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে ধরে নিই।  

পুজ্যতা এবং দেবত্ব পৃথক। এবং সেই পার্থক্য বোধের জন্য যেটুকু অনুশীলন এবং অধ্যয়নের প্রয়োজন, দীর্ঘ প্রায় ৯০০ বছরের যবন এবং ম্লেচ্ছ শাসনে তা আমাদের কাছে বিস্মরণ এবং অবাস্তবতার জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। নচেৎ কিছু সিদ্ধাই মাত্রের প্রদর্শনের পটুতা দেবত্বের সমকক্ষ হতে পারেনা, এই বোধ প্রাচীন ভারতবর্ষে স্বাভাবিক ছিল। মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের চরিত্র ততটুকুই কীর্তিত হয়েছে, যতটুকু গাথার প্রয়োজন। পিতামহ ভীষ্মের মত নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচারীর দৃষ্টি, মহর্ষি গর্গের মত তপস্বীর দৃষ্টি প্রয়োজন হয়েছে সেই শ্রীকৃষ্ণকে পূর্ণ অবতার জ্ঞান করার জন্য। তাঁর জীবনকালে তিনি কিন্তু কোন ঐশ্বরিক ক্ষমতায় ভূষিত একজন ঈশ্বর হিসেবে আত্মপ্রকাশ বড় একটা করেন নি। সামান্য একজন ক্ষত্রিয়ের জীবনযাপনই করেছেন। সে তাঁর ইচ্ছাই হোক, বা অনুগ্রহ। যবন শাসনের আগে ভারতবর্ষের জ্ঞানচর্চার আকাশে যেসব অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্রদের উদয় হয়েছিল, তাঁদের সিংহ ভাগই শুষ্ক জ্ঞান বিচারের পক্ষপাতী ছিলেন না। ভারতীয় জ্ঞানচর্চার পরম্পরা আজও একই ভাবে অব্যাহত আছে। তাঁদের রচনা, কৃতি, সূত্র, ভাষ্য ইত্যাদি ভাবের অতল সমুদ্রের সাথে সাথে অসীম মেধা ও পাণ্ডিত্যের যে অটল মৈনাক প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তা সন্ধানীদের চোখ এড়িয়ে যায়নি। দ্বাদশ শতাব্দীতে আর্যবর্তের শাসনদণ্ডের  দুর্ভাগ্যজনক পরিবর্তনের সূত্রে জনমানসে বৈদিক চেতনার ভিত্তি এতখানি বিঘ্নিত হয় যে তাৎকালিক ফল ভিন্ন অন্য কোন রকম প্রমাণের সামর্থ্য অস্বাভাবিক ভাবে লঘু হয়ে পড়ে। তার ফলস্বরূপ অধ্যাত্ম চেতনার সম্যক বিস্তার যে কখন চটুল ধর্মীয় সার্কাসে পরিণত হয়েছে, তা আমাদের আজ আর বোঝা সম্ভব নয়। 



রাজকন্যা মীরার জীবনী কিছু প্রেক্ষিতে শ্রী আন্দল আলবারের সাথে সাদৃশ্য রেখেও স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে কিছু পারম্পর্যে। বৈষ্ণব উপাসনা ক্রমের সার্থক প্রকাশ তাঁর রচনায়। সঙ্গীতের নিরহঙ্কার পাণ্ডিত্য তাঁর গীতি মালিকার ছত্রে ছত্রে। "मोहे लागी लगन गुरु चरणन के" এই অতি প্রসিদ্ধ পদের রচয়িত্রী তাঁর রচনায় যেভাবে পাঞ্চরাত্র আগমের মূল তত্ত্বগুলিকে সুকৌশলে সাজিয়ে দিয়েছেন, তার সমকক্ষ কোন কৃতি ন ভূতো ন ভবিষ্যতি। কিন্তু বিচার্য বিষয় অন্য। রথক্রান্তীয় অতি জনপ্রিয় কৃষ্টি যেভাবে বিভিন্ন ভজন আদির মাধ্যমে পর ব্রহ্মের হ্লাদিনী শক্তি শ্রীরাধিকা পরমেশ্বরীর সাথে তাঁর তুল্যতা স্থাপন করে, সামান্য মনুষ্যের আধা বিচারী আধা ভক্ত চৈতন্য তার দ্বারা কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভক্তির পরাকাষ্ঠা জ্ঞানের বা আচার্য উপদেশের আলোকে বিকশিত না হলে সেই ভক্তি যে অগ্নির ন্যায় অরণিভক্ষী হয়, তার প্রমাণ আমাদের বর্তমান সমাজ। কর্মহীন জ্ঞান যেমন বিষ বৎ, জ্ঞানহীন ভক্তি তেমনই মৃতবৎসা। তাই বিচারের অবশ্যম্ভাবী প্রমাদে নিজদের অজান্তেই দেবদুর্লভ চরিত্ররা তাঁদের সিংহাসন থেকে নেমে আসেন। এতে ওনাদের মহত্ত্ব এবং আমাদের দীনতা বৃদ্ধি পায় মাত্র। 

মীরাকে ক্বচিৎ কেউ চিনেছেন। বা তাও নয়। বৈষ্ণব আচর্যদের রশ্মিমালায় তিনি চির উজ্জ্বল জ্যোতির্মণ্ডল। প্রশ্ন থেকে যায়, আমরা কেন চিনে উঠতে পারলাম না? দম্ভের প্রমাদ নাকি আত্ম প্রবোধ?








মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শ্রী শ্রী মনসা

কুরুক্ষেত্র গল্প না ইতিহাস?

শ্রী শ্রী মৎস্য বারাহী (পর্ব ১)