কুরুক্ষেত্র গল্প না ইতিহাস?

अर्णांसि चित्पप्रथाना सुदास इन्द्रो गाधान्यकृणोत्सुपारा ।

শাস্ত্রবাক্যে সংশয় করা আমাদের ছোটবেলা থেকে মজ্জায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেখানে শাস্ত্র বাক্যে অচল বিশ্বাস পরমার্থ সাধনের একমাত্র পন্থা, সেখানে আমাদের চিরাচরিত ব্রিটিশ ঘেঁষা শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের সেই শাস্ত্রবাক্যেই চূড়ান্ত অবিশ্বাসের বীজ বপন করে দিয়েছে। এর ফলশ্রুতি স্বরূপ আমরা বেদবাক্য, আগমবাক্য, গুরুবাক্যের ওপর এক লহমায় চূড়ান্ত বিশ্বাস আনতে পারি না। কিন্তু এই ধরণের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আমাদের একটি উপকার হয়েছে। উপকারটি হল, যে আমরা বেদবাক্য, আগমবাক্য, গুরুবাক্যের ওপর এক লহমায় চূড়ান্ত বিশ্বাস আনতে পারি না। প্রশ্ন করি। উত্তর খোঁজার জন্যেই প্রশ্ন করি। তাই নিতান্ত অভদ্র না হলে, আমাদের প্রশ্নগুলো "পরিপ্রশ্নেন সেবয়া" ই হয়ে থাকে। সেই উত্তর পাওয়ার পরে আমাদের যে বিশ্বাসটি জন্মায় সেটি হয় একেবারে মৈনাক পর্বতের মত; নিরন্তর অজস্র গগনচুম্বী তরঙ্গের মাঝেও নিশ্চল। শাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য আমাদের এই মনোবৃত্তি আদর্শ নয়। কিন্তু তাই বলে শাস্ত্র অধ্যয়ন থেকে আমরা বিরত থাকিনি। "ব্রাহ্মণঃ নিঃশ্রেয়সঃ স্বাধ্যায়ঃ অধ্যেতব্যঃ" এই শ্রুতিবাক্যের অন্ধ অনুসরণ করে আমরা শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি। পদে পদে ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত মন প্রশ্ন করেছে। আর শাস্ত্রজননী শারদাম্বিকা তাঁর ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে আমাদের ধৃষ্টতা সকল মার্জনা করে আমাদের উত্তর দিয়েছেন। আমাদের বিশ্বাস হয়েছে মৈনাক। আমাদের কর্মকাণ্ড হয়েছে সূর্য। 

ঠিক এমনই এক সংশয় আমাদের ছিল, যখন আমরা জানলাম মহাভারত "মহাকাব্য" নয়। সংস্কৃত বাঙময়ে মহাভারত হল "ইতিহাস"। এই ইতিহাস আমাদের পরিচিত HISTORY পদের সমানার্থক নয়। কিন্তু তার মধ্যে অধিকাংশ বিষয়ই  প্রত্যক্ষ প্রমাণ থেকে প্রামাণ্য।সংস্কৃত বাঙময়ে শাস্ত্র বলে স্বীকৃত যেসব গ্রন্থ রয়েছে, তার মধ্যে বর্ণিত বিষয় সমূহের আত্যন্তিক সত্যতা প্রত্যক্ষাদি ত্রিবিধ মূল প্রমাণের অপেক্ষা রাখে। সেই প্রত্যক্ষ আবার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং যোগারূঢ়ি ভেদে দ্বিবিধ।  ইতিহাস গ্রন্থের বিষয়গুলিতে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রমাণের আধিক্য রয়েছে এবং এখানেই অন্যান্য শাস্ত্র থেকে ইতিহাস গ্রন্থের স্বাতন্ত্র্য। মহাভারতের ওপর ধুলো উড়িয়ে চরম গবেষণা হয়েছে এবং এখনও হয়ে চলেছে। তার থেকে তথ্যও উঠে আসছে প্রচুর। এমন সব সে তথ্য, যে ইতিহাস আর HISTORY র ব্যাবধান কমিয়ে আনছে ক্রমাগত। আমার প্রশ্নটা ছিল অন্য জায়গায়। মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত সমস্ত পৌরাণিক আখ্যান বেদ স্বীকৃত। খুব অদ্ভুত ভাবে বেদ স্বীকৃত! কিন্তু সেখানে কুরুক্ষেত্রের মত একটা ঐতিহাসিক মূল ঘটনার বেদে কোন উল্লেখ থাকবে না? সাক্ষাৎ শ্রীনারায়ণের পূর্ণ অবতারের এক মনুষ্যকে নিজের বিশ্বরূপ দেখিয়ে দেওয়ার মত ঘটনা অনুগ্রহকৃত্য বলে বেদে উল্লেখ থাকবে না? যদি আছে তো কীভাবে আছে? এর আগে আমরা দেখেছি, সতীর দেহত্যাগের আসল বেদ স্বীকৃত ঘটনা। দেবী পদবাচ্য কোন অস্তিত্ব নিজের স্বামীর নিন্দা শুনে তাঁর অজস্র উপাসকদের, ভক্তদের সামনে আত্মহত্যার মত একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন না। বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকে রুদ্রহীন যজ্ঞের বর্ণনা এবং সেই যজ্ঞে দেবতাদের সামনে উপস্থিত বিঘ্ন, সেই বিঘ্ন নিবারণের জন্য রুদ্রের প্রীতি যাচনা এই সমস্ত উপাখ্যান আমরা পেয়েছি। আমাদের মনের সংশয় দূর হয়েছে। তৈত্তিরীয় আরণ্যকের ঘটনাটিকে অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে গোপন করে একেবারে নতুন ধরণের একটি গাথা রচনা করে "রুদ্রহীন যজ্ঞ নিষ্ফল" এই তত্ত্ব মহর্ষি বেদব্যাস যেভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তা নিঃসন্দেহে ভ্রামক একটি পন্থা। মহাভারতও ব্যাতিক্রম নয়। আমাদের ছোটবেলায় ইতিহাস বইতে পড়ানো হয়েছিল, "বেদের তত্ত্ব সকলের বোধগম্য করার জন্য পুরাণে গল্পের ছলে সেই সব তত্ত্ব প্রকাশ করা হয়েছিল।"  বেদ আর বেদব্যাসের রচনা পাশাপাশি রেখে না পড়লে  এই শিক্ষাটি সহজে বোঝা সম্ভব নয়। বেদের কোন তত্ত্ব যে বেদব্যাস কীভাবে আমাদের সামনে এনে রেখেছেন, এবং আজন্ম যে আমরা কীভাবে সেইসব গাথা নিজেদের অজান্তেই মেনে চলেছি, তা আমরাই জানি না। অলক্ষ্যে হাসেন বিষ্ণু অবতার মহর্ষি বেদব্যাস। 

বেদের সপ্তম মণ্ডলে একটি যুদ্ধের বর্ণনা আছে। বর্ণনা করছেন মহর্ষি বশিষ্ঠ নিজে। সেই যুদ্ধের পোশাকি নাম দাশরাজ্ঞ যুদ্ধ; দশ রাজার যুদ্ধ। এই যুদ্ধ হয়েছিল ভরতের বংশের রাজার সাথে বহু রাজার এক সংগঠিত শক্তির সাথে। এই যুদ্ধে ভরত বংশ বিজয়ী হয় এবং এই বিজয় কুরু বংশের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায় সংযুক্ত করে। যুদ্ধের স্থান কুরুক্ষেত্র। ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলের অষ্টাদশ সূক্তে এই যুদ্ধের বর্ণনা পাওয়া যায়। কুরুক্ষেত্রের পশ্চিমে পারুশ্নি নদীর তীরে এই যুদ্ধ শুরু হয়। ভরত বংশীয় সম্রাট সুদাস এবং তার কুলগুরু মহর্ষি বশিষ্ঠ যে রাজশক্তি সঙ্ঘের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন সেই সব বংশের নাম, যথাক্রমে পুরু, যদু, যক্ষু, মৎস্য, দ্রুহ্য, পক্ত, ভলন, অলিন, বিষাণি, শিব, বৈকর্ণ এবং অনু। মহারাজ সুদাসের সেনাবাহিনীর সংখ্যা তাঁর শত্রুদের তুলনায় নিতান্ত "অপর্যাপ্ত" ছিল। কিন্তু দেবরাজ ইন্দ্রের একনিষ্ঠ উপাসক সুদাসকে দেবরাজ ইন্দ্র নিজে মার্গ প্রদর্শন করেন এবং বিবিধ কৌশলে তার শত্রুদের ওপর প্রবল করে তোলেন। দেবরাজ ইন্দ্রের মার্গ দর্শনে সুদাস নদীর ওপর একটি অদ্ভুত বাঁধ তৈরি করেন এবং জলের স্রোতের শক্তি ব্যবহার করে তাঁর শত্রুদের ডুবিয়ে হত্যা করেন। তাঁর কৌশলের সামর্থ্য এতখানি নিপুণ ছিল, যে বহু সংখ্যক প্রবল পরাক্রমী শত্রুদের একত্রে সংহার তাঁর কাছে সহজসাধ্য হয়ে যায়। যুদ্ধক্ষেত্রে মহর্ষি বশিষ্ঠের ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে করা নিপুণ মন্ত্রপাঠে তুষ্ট হয়েই দেবরাজ সুদাসের ওপর অনুগ্রহ করেন। এর পরে এই যুদ্ধ যমুনার তীরে এসে উপনীত হয়। সেখানে সুদাস, ভিদা এবং অজ, শীঘ্র এবং যক্ষু সৈন্যদের পরাজিত করেন। সন্তুষ্ট দেবরাজ সুদাসের সামনে নেমে আসেন, দর্শন দেন "বিশ্বরূপে"। দেবরাজ ইন্দ্রের মধ্যে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড দর্শন করে অনুগৃহীত হন, কৃতার্থ হন মহারাজ সুদাস। মহর্ষি বশিষ্ঠ দর্শন করেন ইন্দ্রসূক্ত। নিঃশত্রু সম্রাট তাঁর জয় উদযাপন করেন অশ্বমেধ যজ্ঞ করে। তাঁর শত্রুরা যমুনা- সরস্বতী নদীর ভূভাগ ত্যাগ করে পৃথিবীর বিভিন্ন কোণায় গিয়ে বসতি স্থাপন করে এবং একটি করে স্বতন্ত্র সভ্যতা গড়ে তোলে। কিন্তু তখনও খাণ্ডবপ্রস্থ অরণ্যে কীকট জনজাতির লোকরা বাস করত এবং তারা সুদাসের শত্রুস্থানীয়ই ছিল।সমস্ত খাণ্ডবপ্রস্থ দহন করে সুদাস তাঁর রাজ্যের সীমা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করেন। 

অতএব বেদ মাত্র কয়েকটি মন্ত্রে সরাসরি যে গাথা বর্ণনা করেছেন, মহাভারতে সেই ঘটনাই শত সহস্র সংহিতা হয়েছে। আর্য সভ্যতার বিদেশি ভিত্তি এই উপাখ্যানে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন সভ্যতার পৌরাণিক গল্পের সাথে ভারতীয় পুরাণের সাদৃশ্যের কারণ এই গাথা থেকে স্পষ্ট হয়। আরও না জানি কত অনুত্তর প্রশ্নের উত্তর এই দাশরাজ্ঞ যুদ্ধে লুকিয়ে আছে, তা কেবল বেদনিষ্ঠ কর্মকাণ্ডী ব্যতীত কেই বা বলতে পারে!  

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শ্রী শ্রী মনসা

The Kalyaneswari Temple, Lepodi

Maa Ghagar Buri (Part-I)