শ্রী শ্রী মনসা

দুপুর পর্যন্ত অজস্র কোলাহলমুখর, শশব্যস্ত পুরুলিয়া শহর বিকেল পড়তেই ক্রমে ক্রমে নিঃশব্দ হয়ে আসে। রাত্রি দশটা এগারোটা পর্যন্ত যেসব দোকানে ভিড় জমা থাকত, বিকেল চারটে বাজতেই তাদের ঝাঁপ এক এক করে বন্ধ হতে থাকে। চূড়ান্ত যানজটে যেসব রাস্তাঘাটে দু পা চলা দায়, সন্ধ্যা নামতে সেইসব রাস্তা শুনশান। রাস্তায় কেবল নিজের গ্রামে ফিরে যাওয়ার উদগ্র ব্যাকুলতায় কিছু বাইক আরোহী। তাদের জীর্ণ backpack, মুখে সারাদিনের ক্লান্তি, কিন্তু চোখে আশা ঠিক সময়ে বাড়ি পৌঁছানোর। কারণ ফিরে গিয়েই বিধিবৎ স্নানাদি করে, নতুন ধুতি পরে প্রস্তুত হতে হবে। প্রায় নির্জন, অন্ধকার, নিস্তব্ধ পুরুলিয়া শহরের রাস্তায় রাস্তায় কিছুক্ষণ পরে পরেই কেবল একদল মানুষ সিক্ত বসনে নিজের মাথায় একটি ফণীমনসার ডাল ধরে, তার নিজের সামর্থ্যমত বাদ্যাদির সাথে কাছের কোন জলাশয়ের দিকে চলেছে শোভাযাত্রা করে। রাস্তায় আর কিচ্ছু নেই। সারা শহর জুড়ে একটাই উদ্যোগ, শ্রী শ্রী ভগবতী সর্পরাজ্ঞী মনসার পূজা। পুরুলিয়া শহরের বৃহত্তম আনন্দ উৎসব। 


সন্ধ্যা নামে। রাস্তাঘাট আরও ফাঁকা হয়ে আসে। শোভাযাত্রার দল বাড়তে থাকে। কিছু শোভাযাত্রায় দেবীর মূল ঘট আর ফণীপত্রিকার সাথে তাল মিলিয়ে হেঁটে চলেন গৃহবধূরা। তাঁদের হৃদয়ে কৃতাঞ্জলি ধৃত আর মাথার ওপর দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে ধুনোর সরা। শ্রাবণের অঝোর বৃষ্টি সেই অগ্নিশিখার দম্ভ কণামাত্র কমাতে পারেনা। সাথে একজন করে বাড়ির সদস্য হাতে ধুনোর জোগান নিয়ে তাল মিলিয়ে চলেন আর ক্রমাগত সেই অগ্নিপাত্রে ধুনো ছুঁড়তে থাকেন। এই শোভাযাত্রাগুলি অতি দুর্লভ দৃশ্য। আলাদা আলাদা করে দেখলে নিতান্ত সাদামাটা; কয়েকজন মানুষমাত্র হেঁটে চলেছেন দেবীর কলশ মাথায়। দুর্লভ দৃশ্য হল এই সামগ্রিক চিত্রটি। কোন শোভাযাত্রাতেই বাদ্যযন্ত্রের আড়ম্বর নেই, কোন নাচ গান নেই, অযথা উল্লাস নেই, নেই ক্ষমতা প্রদর্শনের ঔদ্ধত্য। প্রত্যেকে নিঃশব্দে চলেছে দেবীর শ্রীপাদপদ্ম চিন্তা করতে করতে। দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, যে ওনাদের কাছে জগৎ জীবন সব কিছু মিথ্যা হয়ে গেছে। একমুখী চিন্তার প্রত্যয় প্রত্যেকটি মানুষের চোখে মুখে ঝলক দিয়ে যায়। দেবীর এই সাম্বৎসরিক মহোৎসবে যারা প্রত্যক্ষদর্শী থাকে, তারাই জানে, কীভাবে একদল মানুষের কাছে এক সন্ধ্যার জন্য অবলীলায় একটা ব্রহ্মাণ্ড মিথ্যা হয়ে যেতে পারে। মনসা পূজার লৌকিকত্ব বা বৈদিকত্ব প্রতিষ্ঠার ঘনঘোর তর্কযুদ্ধ, আর্য-অনার্য  দ্বন্দ্বের পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিশ্লেষণ, anthropologist দের অতিশিক্ষিত রক্তচক্ষু নিমেষের মধ্যে মিথ্যা হয়ে গিয়ে চিন্তায় চেতনায় এক অদ্ভুত উদ্দীপনা কাজ করে। তার জন্য প্রত্যক্ষভাবে দেবীর পূজার সাথে সংশ্লিষ্টও থাকতে হয়না। একজন নিত্য কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত মন্ত্রীর একক চৈতন্যকে সমগ্র পুরুলিয়াবাসীর সামগ্রিক চৈতন্য পরশমণির মতন শ্রাবণ সংক্রান্তির সূর্যাস্তের আলোর মত স্বর্ণাভ করে তোলে। নিতান্ত অজান্তেই কখন যেন রমা, মায়া আর কামসংযুক্ত, বহ্নিজায়ান্ত দেবীর মূলমন্ত্রটি রণিত হতে থাকে মন্ত্রীর সত্তায়। 





সেই ছোট্ট বেলা থেকে দেবীর পূজা দেখে আসছি। এই মহোৎসব দেখে আসছি। আজও আশ্চর্য লাগে দেবীর এই পূজার প্রতিষ্ঠাগত শৃঙ্খলা দেখে। অত্যন্ত সুচিন্তিত এবং সুশৃঙ্খলিত সম্বৎসরব্যাপী অনুষ্ঠানকৃত্যের মধ্যে মনসা পূজার অবস্থান। শ্রাবণ সংক্রান্তিতে দেবীর পূজা, অর্থাৎ সূর্যের কর্কট রাশিতে সঞ্চরণের শেষ দিনে। এই পূজা চান্দ্র তিথি ধরে হয়না, হয় সৌর তিথিতে। দেবীর পূজার প্রচলিত বিধানেও সূর্যের মাহাত্ম্য যথেষ্ট। আষাঢ় মাস আসতেই আকাশে মেঘ জমে সূর্য আড়াল হয়ে যান, আর দীর্ঘ দু'মাসের জন্য মেঘের আড়ালে লুক্কায়িতই থাকেন। এই বর্ষাকাল বা প্রাবৃটকালের প্রাকৃতিক গতিই মানুষের সারাবছরের জীবনধারণের রসদ। এই সেই সময় যখন মাঠে ফসল, জলে মাছ চাষ শুরু হয়। শীতের রুক্ষতা আর গ্রীষ্মের দহন কাটিয়ে পৃথিবী সম্যক ভাবে স্নাত হন। বৈদিক সিদ্ধান্তে এই সময়কে ধরিত্রীর গর্ভাবস্থা বলে।অনুষ্ঠিত হয় বরুণ প্রঘাস যজ্ঞ। শ্রীহরিও এই সময় নিদ্রায় চলে যান। দেবযান নিদ্রিত থাকে। এই অন্ধকার কাটিয়ে সূর্য প্রকাশ হন সিংহবিক্রমে, সূর্যের সিংহ রাশিতে সঞ্চারের সাথে সাথে, অর্থাৎ পয়লা ভাদ্র। গুহার অন্ধকারে লুক্কায়িত সত্তার সিংহবিক্রমে আলোয় প্রবেশ মন্ত্রী চৈতন্যের একক সত্তায় বহুযুগের নিদ্রিতা কুণ্ডলীকৃতা শক্তির জাগরণ এবং স্ফুরণের মত সত্য। সেই চৈতন্য শক্তি, যিনি জীবদেহের মূল সত্তা হয়ে তাকে কর্মে প্রবৃত্ত করেন, শস্যের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে জীবের পালন করেন পোষণ করেন, তিনিই উপাসিতা হন এই শ্রাবণ সংক্রান্তিতে। সেই চৈতন্য শক্তির মহদুপাসনাই শ্রী শ্রী মনসা পূজা।


প্রশ্ন হল, পুরুলিয়ার অগণিত জনগণ, যারা বংশ পরম্পরায় শ্রাবণ সংক্রান্তিতে এই দেবীর উপাসনা করে আসছে, তাদের কতজন এই গুহ্য শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্ত সম্পর্কে সচেতন! এর উত্তর শূন্য। কেউ না। কারণ ওদের এইসমস্ত সিদ্ধান্ত না জানলেও হবে। বরঞ্চ জেনে ফেললে ভক্তির হানি হতে পারে। সারস্বত সাধনার যৎসামান্য কিছু challange এর মধ্যে এটি একটি। তাই ওদের পূজা যেমন করেই হোক পূর্ব বর্ণিত বৈদিক সিদ্ধান্তের খণ্ডন তো করেই না, উপরন্তু বছরের পর বছর আত্যন্তিক নিষ্ঠায় ও সেবায়, এই ছোট্ট শহরে প্রাচীন বৈদিক সিদ্ধান্তকে সুদৃঢ় ভাবে ধারণ করে রয়েছে। "যাগাদিরেব ধর্মঃ" এই জৈমিনি সিদ্ধান্তের অত্যন্ত সাবলীল অভিব্যক্তি পুরুলিয়ার মনসা পূজা অক্ষয় হোক, ভগবতী একে অক্ষয় করুন।   

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কুরুক্ষেত্র গল্প না ইতিহাস?

শ্রী শ্রী মৎস্য বারাহী (পর্ব ১)