শ্রী শ্রী মৎস্য বারাহী (পর্ব ১)

 ২০১৭ সালের ঘটনা। ফেসবুকের ফিডে একটি পোস্ট আসে। গুণলয়ানন্দ স্বামীর লেখা একটি যাত্রা বিবরণী। শ্রী রামকৃষ্ণ মিশনের এই সন্ন্যাসীর লেখনীতে উড়িষ্যার এক শক্তি পীঠের বর্ণনা ছিল। লেখাটি দেখে মনে করে রেখেছিলাম, একবার যেতে হবে। মনে ছিল দুটি মূল শব্দ, শ্রী শ্রী বারাহী আর সহস্রলিঙ্গ। তারপর সময় বছর দুই তিন পেরোতেই জীবনের মোটামুটি একটু শান্ত সময় খণ্ডে মনে হল, এই সময় দর্শন করে আসি। উড়িষ্যার শ্রী শ্রী বারাহী শক্তিপীঠ। সাধারণত উড়িষ্যা রাজ্যে এই ধরনের কোন দেবস্থান দর্শনে বা সন্ধানে বেরোলে, বিশেষত যার সবিশেষ উল্লেখ ইন্টারনেটে পাওয়া দুষ্কর,  প্রথম বেস ক্যাম্প হয় শ্রীক্ষেত্র। সেইখান থেকেই এবার স্থানীয় দের সাথে কথা বলে বলে খুঁজে বের করা।  এবারেও তাই করা হল। কিন্তু শ্রীক্ষেত্রে গিয়ে হাজার সন্ধান করেও কোন বারাহী শক্তিপীঠের সন্ধান পেলুম না। শেষে সমুদ্রের তীরে চায়ের দোকানে একজন ট্রাভেল এজেন্টের সাথে আলাপ হতে, তিনি তাঁর ভাঙা বাংলায় বললেন, "শক্তিপীঠ কিনা জানি না, দাদা। তবে এখান থেকে মোটামুটি ৫০ কিলোমিটার দূরে এক প্রাচীন মন্দির আছে। সেই মন্দিরে দেবী বারাহীর পূজা হয়।" 

পরদিন সকালে হোটেলের কাছ থেকে একটি বাইক ভাড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম শ্রী শ্রী বারাহীর সন্ধানে। গুগল ম্যাপ্স সোজা রাস্তা দেখিয়ে দিল চৌরাশির শ্রী শ্রী বারাহী মন্দিরের। সেইদিন সন্ধ্যায় ছিল শ্রীজগন্নাথের সুনাবেশ। শ্রীক্ষেত্রের রাস্তাঘাট সাধারণের থেকেও বেশী জনবহুল। পুরো উৎকল রাজ্য এক দৃষ্টে চেয়ে রয়েছে রথে আসীন বামনের দিকে। চৌরাশি যাবার পথে রাজপথ পেরোতে চোখে পড়ল, দূরে শ্রীমন্দিরের সামনে দণ্ডায়মান তিনটি রথ। আর সেই রথের অভিমুখে হাজার হাজার নরনারীর একাগ্র যাত্রা। প্রণাম তোমায়, দারুব্রহ্ম। কিন্তু এখন গন্তব্য অন্যত্র। আষাঢ়ের দণ্ডিনী নবরাত্রির শেষে এখন গন্তব্য শ্রী শ্রী দণ্ডনাথা। রাজপথ আর ত্রিরথ পেছনে রেখে এগিয়ে চললাম চৌরাশির পথে। বর্ষাকাল, তায় মেঘলা আকাশ। সমুদ্র তীরবর্তী উৎকল রাজ্যে এই পরিবেশ বিশেষ কষ্টকর। একটা দম বন্ধ ভ্যাপসা গরম। তার ওপর মাঝে মধ্যেই ঝিমঝিমিয়ে বৃষ্টি নেমে আসছে। ভারী বর্ষা নয়, কিন্তু আবার রাইড করার জন্যেও অসুবিধাজনক। সেই বৃষ্টির দৌরাত্ম্যে ৫০ কিলোমিটার রাস্তা যেতে ২.৫ ঘণ্টা সময় লাগল। সেই ঘণ্টা আড়াই রাইড করে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম চৌরাশি। 

নিতান্ত সাদা সিধে একটি ছোট্ট গ্রাম। কোলাহল একেবারেই নেই। কিন্তু বর্ষার নিস্তব্ধতার যে একটা শব্দ আছে, সেই শব্দ চারিদিকে। মাঝে মাঝে পথে পড়ছে হাল কাঁধে কোন বৃদ্ধ কৃষক, তাঁর বলদ দুটি নিয়ে ক্ষেতে চলেছেন। কোথাও বা একদল কচি কাঁচা সাইকেল ঠেলে ঠেলে চলেছে জীবনের প্রাথমিক পাঠগুলি গ্রহণ করতে গ্রামের সরকারী পাঠশালায়। একটি শান্ত, নিস্তব্ধ, অপাপবিদ্ধ গ্রামের চিত্র। তার মধ্যে, তিন চারটি গ্রাম্য পাড়া মহল্লা দিয়ে বেষ্টিত হয়ে স্বমহিমায় অটল দাঁড়িয়ে রয়েছে চৌরাশির শ্রী শ্রী বারাহী মন্দির। যতক্ষণে সেই স্থানে পৌঁছেছি, ততক্ষণে এই বোধ তো হয়ে গেছে, যে এই স্থানের সন্ধানে আমি আসিনি। দেবীর শ্রীমন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে মনটা দুটো দলে ভাগ হয়ে গেল। একদল বলল, "এর সন্ধানে পথে নামিনি। এই স্থান সেই শক্তিপীঠ নয়। ফিরে চল। আবার খোঁজ শুরু কর।" আরেক দল বলল, "এ কোন জায়গায় এসে পড়লাম! কোন আকর্ষণে আজ দণ্ডিনী নবরাত্রির শেষে এখানে আসা! যে দেবীর ত্রাসে, সাধকগণ সামান্যতমও অনুশাসন থেকে বিচ্যুত হন না, তিনি এ কেমন পরিবেশে রয়েছেন!" খুব সহজেই দ্বিতীয় মনের দল বিজয়ী হল, আর আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মত প্রবেশ করলাম দেবীর শ্রীমন্দিরের প্রাঙ্গণে। উৎকলের সহজাত অত্যুৎকৃষ্ট ভাস্কর্যে মণ্ডিত এক প্রাচীন দেউল। ভারতের পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের অধীনে এখন এই মন্দির ঘিরে এক সাজানো বাগান তৈরি হয়েছে। মন্দিরের মূল দ্বার তখনও রুদ্ধ। সকালে গ্রামের কেউ নিত্য পূজার ফুল, বেলপাতা, যত্ন করে বাছা দূর্বা একটি প্লাস্টিকে ভরে নামিয়ে দিয়ে গেছে দেবীর মন্দিরের দরজায়। মূল দ্বারে কোন তালা নেই। আলতো করে কেবল ছিটকিনি দেওয়া আছে। 

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শ্রী শ্রী মনসা

The Kalyaneswari Temple, Lepodi

Maa Ghagar Buri (Part-I)