যাত্রা সাহিত্য

 নতুন শিখলাম, যাত্রা সাহিত্য বলে একটা ব্যাপার হয়। ঠিক "ভ্রমণ কাহিনী" নয়, "যাত্রা সাহিত্য"। দুটোর মধ্যে যে একটা সূক্ষ্ম ভেদ রয়েছে, তা পাঠক মাত্রেই কিঞ্চিৎ আন্দাজ করতে পারছেন বই কি! তা, সেই ভাবে ভেবে দেখলাম, যে এই ভাবে কখনও ভেবে দেখিনি তো! তাই আবার, ছোটবেলার লেখার খাতায় লিখতে এলাম। নতুন করে পুরনো জিনিস ভাবতে হলে, লিখতে লাগে। যাত্রার পথের সাথে এই শরীরের আত্মীয়তা তো আর আজকের নয়; অনেক পুরনো। বরং বলতে গেলে, কয়েক জন্মের পুরনো। কখনও কখনও হয়ত বা কোন বাদলার রাতে স্বপ্নে দেখা যায়, সেই প্রথম দিনের গল্প; যেদিন ঘর ছেড়ে পথে নেমেছিলাম। কিছু একটা খুঁজতেই নেমেছিলাম। কিন্তু সেটা যে ঠিক কি ছিল, এত জন্ম পরে আর সেটা মনে করা সম্ভব না। হয়ত খুঁজে পাওয়াও হয়ে গিয়েছে সেই যখের ধন। কিন্তু যাত্রা আর ফুরায় নি। একের পর এক নতুন, অযাচিত গন্তব্য এসে জুড়ে গেছে পথের সাথে। পথ হয়েছে আরও দীর্ঘ, আরও জটিল। ঘরে ফেরার যে রাস্তায় মণি মুক্তো ছড়াতে ছড়াতে এসেছিলাম, ফেরার পথ চিনব বলে, সেই পথে আজ ঘন জংলা ঝোপ জন্মেছে। যেন একটা আস্ত অরণ্য গ্রাস করেছে, ঘরে ফেরার পথ চিহ্নগুলো। 

এমন করেই দিনে দিনে যাত্রা পথটা ঘর হয়ে যায়। অচেনা মুখের ভিড়গুলো আত্মীয় হয়ে ওঠে। আর যেখানে জন্ম হয়েছিল, সেই যে কতকাল আগে, তাদের মুখ চেনা হয়ে ওঠে এক বিষম দায়। আর একটা গোটা পৃথিবী যখন ঘর হয়ে ওঠে, তখন জীবনযাত্রাটা যাত্রাজীবন হয়ে ওঠে; একটা অর্থ পায়। হয়ত এরকমই কোন এক স্থিতি কালে কালে পথিকদের সাহিত্যিক করে তুলেছে। পথিকের কলমে ভাষা পেয়েছে অজস্র মূক, তাদের কথা শুনেছে অজস্র বধির। নগর সভ্যতার কোলাহল ভেদ করে মানুষের কানে গিয়ে উঠেছে এক পৃথিবী মানুষের কথা। তবেই তো সেই সাহিত্য পূর্ণতা পায়, যখন সাহিত্যিকের কলমে মানুষের কথা চিৎকার হয়ে, গর্জন হয়ে নেমে আসে। অন্য সাহিত্য, সে তো আত্ম গরিমার, আত্ম ঘোষণার মতই হাস্যকর। তাই মনে পড়ল, অনেকের কথা তো আমার লেখা হল না! শীতের দুপুরে অযোধ্যার নির্জন শিখরের সেই বৃদ্ধার কথা, বা গ্রীষ্মের দুপুরে চণ্ডীগড়ের সেই ড্রাইভারের কথা। শাস্ত্র অধ্যয়নের শেষে, গুরু বলেন, "যাও, চার ধাম দর্শন করে এসো।" বলেন, দেখে এসো, মানুষের মধ্যে দিয়ে নিরন্তর শাস্ত্রের গতি। প্রত্যক্ষ করে এসো ধরিত্রীর সন্তানদের মধ্যে মহাকালের ধীর পদক্ষেপ। তাদের কোটি কণ্ঠের সম্মিলিত জয়ধ্বনি, তাদের না-পাওয়ার কান্না, তাদের উল্লাসের গর্জনে শুনে এসো সনাতনী মন্ত্রের অনুরণন। দেখেছি, শুনেওছি। কিন্তু ঐ কালের যাত্রায় যদি দিনে দিনে বিস্মৃত হতে বসি, সেই সব অব্যক্ত কৃপারত্ন সম্ভার? সেই তাঁর অত বড় দানের যে চূড়ান্ত অমর্যাদার কলঙ্ক এই মাথায় লাগবে, তা কোনদিন মিটবে না। তাই যাবৎ সব মনে আছে, আবার লেখা শুরু করি। পড়ে থাকুক অন্তর্জালের এক কোণায়।

  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

শ্রী শ্রী মনসা

কুরুক্ষেত্র গল্প না ইতিহাস?

শ্রী শ্রী মৎস্য বারাহী (পর্ব ১)